একজটা তারাপূজা ও সোমরার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের ইতিকথা। দেবী এখানে একজটা, নীলবর্ণা , খর্বাকৃতি , লোল জিহ্বা , করাল বদনা, ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা , চতুর্ভূজা, সর্পালঙ্কারা।লিখছেন–সোমরার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সদস্য দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

কালীময় বঙ্গভূমি
বাঙালীর ‘কালী-মাতা’ প্রীতি সর্বজনবিদিত। ‘কালী’ময় এ বঙ্গভূমি। সারা বাঙলা জুড়ে এমন কোন গ্রাম, গঞ্জ , শহর বা নগর নেই যেখানে কালীমন্দির নেই। বাঙলার বাইরেও যেথা বাঙালী সেথা কালী মন্দির। এ হেন ‘কালী’-র রূপভেদও দেখা যায় সর্বত্র — দক্ষিণা কালী, বামা কালী, ডাকাত কালী , শ্মশান কালী , সিদ্ধেশ্বরী , রক্ষা কালী আরও কত নাম । তবে ‘কালী’-র বহুবিধ রূপ বর্ণনা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। শাক্ত ও বৈষ্ণব দুই ধারাতেই আমরা কালীর উপাসনা পাই। তবে শাক্ত ধারা বৈষ্ণব ধারার থেকেও প্রাচীন ব’লে ঐতিহাসিকগণের অনুমান। বঙ্গভূমির এই শাক্ত ধারার সাধন ভজন এর প্রভাব আমরা দেখতে পাই এই কালী ও তারা আরাধনার প্রচলনের মধ্যে দিয়ে।এক সময় ‘কালী’ বা ‘তারা’ আরাধনা তন্ত্রমতে শ্মশান অঞ্চলেই হ’ত।
তন্ত্রধারা
পরবর্তীতে নদীয়ার শান্তিপুর-এর কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ -এর হাত ধ’রে ক্রমেই এই শক্তি পুজো গৃহীর পুজোতে রূপান্তরিত হ’ল। তবে গৃহে অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে কালী পুজোর প্রচলন এর তুলনায় ‘তারা’ পুজোর প্রচলন তুলনাত্মকভাবে কম। এই লেখা এমনি এক বিরল ‘তারা’ পুজোকে কেন্দ্র ক’রে।
তার আগে একটা ছোট গল্প বলা যায়।প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগেকার কথা। সালটা সম্ভবতঃ ১৯৯৫ আর সময়টা ছিল রাস উৎসবের সময়। ব্যক্তিগত একটি কাজে শান্তিপুর গিয়েছিলাম একবার। কাজের মধ্যে সামান্য অবসর মিলতেই মনে হ’ল আমাদের পূর্বপুরুষের বাড়ী তো এইখানেই ছিল… একটু অনুসন্ধান ক’রে দেখি। কিছুক্ষণ অনুসন্ধান ক’রেই পেয়ে গেলাম সেই বাড়ী যা কি না আমার ঊর্দ্ধ্বতন সপ্তম পুরুষের একদা বাসস্থান ছিল। হ্যাঁ এই তো আমাদের সেই পৈতৃক ভিটে — শ্যামচাঁদ পাড়ার ‘অন্নপূর্ণা ভবন’।
একজটা তারাপূজা ও শান্তিপুরের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার
আশে-পাশের মানুষজনের সঙ্গে কথা ব’লে জানা গেল যে বাড়ীটি এখন ভাড়া দেওয়া আছে এবং বাড়ির তৎকালীন মালিক কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলে থাকেন। বাড়ীতে ঢুকে যে ভদ্রলোক ঐ বাড়ীটিতে ভাড়া থাকতেন তাঁর সঙ্গে পরিচয় করা গেল। তিনি সামান্য কথাবার্তা শুনেই জানতে চাইলেন যে আমার বিষয়-সম্পত্তিগত কারণে আগমন কিনা; কিন্তু আমি তাঁকে জানালাম যে আমরা প্রায় সাত-পুরুষ হ’ল এই বাড়ী ছেড়ে গেছি, তাই ঐসব বিষয় কিছু নয়; আমার উদ্দেশ্য হ’ল নিজের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস সম্বন্ধে আরও নতুন তথ্য জোগাড় করা, জানা। তখন ঐ ভদ্রলোক বেশ আন্তরিকভাবে কথা বললেন এবং বাড়ীটি ঘুরিয়ে দেখালেন। নানা জায়গা দেখতে দেখতে দেখা গেল মূল বাড়ীতে ছোট্ট ঠাকুর দালান ও তন্মধ্যে পঞ্চমুন্ডীর আসন। বিষয়টি বেশ উৎসাহব্যঞ্জক।

একজটা তারাপূজা ও তন্ত্রসাধনা
আমাদের বর্তমান সোমরা বাড়ীর তারা পূজাও তো বেশ বিখ্যাত। আর পঞ্চমুণ্ডীর আসন তো সাধক ছাড়া কেউ ব্যবহার করেন না;কিন্তু আমার সাত পুরুষের মধ্যে তো কেউ জানা মতে সাধক ছিলেন না। তাহলে কি তৎপূর্ববর্তী আমাদের কোন পূর্বপুরুষ সত্যিই কি সাধক ছিলেন যা একটা ‘মিথ’-এর মতো ধারনায় প্রচলিত আছে আমাদের বংশ পরম্পরায়? বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করব ঠিক করলাম।
ঐ ভদ্রলোক অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই বিশেষ কোন তথ্য দিতে পারলেন না। বাড়ীর কিছু ছবি তুলে নিয়ে আশেপাশে এই বিষয়ে খোঁজ-খবর করার চেষ্টা করলাম। পাড়ার লোকেদের সাথে কথা ব’লে প্রায় দু’শো বছর আগেকার বন্দ্যোপাধ্যায়-দের সম্বন্ধে খুব একটা তথ্য পাওয়া গেল না | অবশ্য কেউ কেউ বললেন জনৈক অশীতিপর বৃদ্ধ বৈকালে চা খেতে পাড়ার দোকানে আসবেন, তিনি কিছু তথ্য হয়তো দিতে পারেন। কিন্তু বৈকাল পর্যন্ত থাকর মতো সময় হাতে না থাকায় হতাশ হয়ে ফিরতে হ’ল। তখন অবশ্য এর থেকে বেশী কিছু জানতে পারা গেল না; কিন্তু কৌতূহল রয়েই গেল। আসলে কিছু তথ্য জানা ছিল। সেই তথ্যের যাচাই করা অথবা অন্য নতুন কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারলে ভালো হ’ত; সেইটাই আক্ষেপ।
শান্তিপুরে
এর বেশ কিছু কাল পর আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে এক পরিচিতের মুখে লেখক জানতে পারলেন যে শ্যামচাঁদ পাড়ার ‘অন্নপূর্ণা ভবন’ ভেঙে আধুনিক ফ্লাট বাড়ি তৈরী হচ্ছে । তিনি অবশ্য যৎসামান্য ইতিহাসও জানিয়েছিলেন, তবে তা উল্লেখযোগ্য নয়। কিন্তু বাড়ী ভেঙে ফ্ল্যাট হচ্ছে শুনে মনটা বিষম ভারী হয়ে উঠল; আবার একবার শান্তিপুর যাত্রা করলাম। সত্যি পুরোনো বাড়ি ভাঙা পড়েছে এবং তৎসহ ইতিহাস ও । আশপাশের মানুষজন নতুন কোন তথ্য দিতে পারেননি তবে খুব আগ্রহ সহ কথা বলেছিলেন। তবে একটা বিষয় জেনে আশ্চর্য্য হলাম যে ফ্ল্যাট তৈরীর সময় নানা বাধায় ঠাকুর-দালান ভাঙা সম্ভব হয়নি — কখনো কোন মিস্ত্রী আহত হয়ে পড়ে, কখনও বা সাপ বের হয় ইত্যাদি বাধায় তখন ঠাকুর-দালান ভাঙা স্থগিত রাখা হয়।

একজটা তারাপূজা সোমরায়
এইবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। হুগলী জেলার সোমরাবাজার এর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার -এর ‘তারা’ পুজো সম্পর্কে বলা যাক্।এই পুজোর প্রচলন অতীত -এ ঠিক কবে হয়েছিল তার লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় না ; তবে এই পুজো আনুমানিক ২৫০ বছর এরও অধিক কাল ধ’রে চ’লে আসছে হুগলী জেলার সোমরাবাজার -এর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে। এই পুজোর সূচনা হয়েছিল নদীয়া জেলার শান্তিপুর -এর শ্যামচাঁদ পাড়ার বন্দ্যোপাধ্যায়দের গৃহে। ওই ভদ্রাসনে ঠাকুর-দালান -এ পঞ্চমুণ্ডীর আসনও ছিল, যা থেকে অনুমান করা যায় এ বংশের কোনও এক পূর্বপুরুষ তন্ত্র সাধনা করতেন। তবে কে এই পুজো করেছিলেন তার মৌখিক বা লিখিত ইতিহাস আজও অজানা।
আনুমানিক ১৮২৫ খৃষ্টাব্দে এই বংশের এক পূর্বপুরুষ, কালিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তস্য ভ্রাতা শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার সাথে শান্তিপুর থেকে সোমরাবাজার -এ তাঁর মাতুলালয়ে চ’লে আসেন এবং তাঁর পর থেকে এই ‘তারা’ পুজো সোমরাবাজার এই অনুষ্ঠিত হচ্ছে গত প্রায় দু’শো বছর ধ’রে। এই মাতুলালয়েতেই কালিদাস বাবুর বাল্যবিধবা মাসীমাতার আরাধ্যা অষ্টধাতুর জগৎধাত্রী মূর্তি পূজিতা হ’ত যা আজও বন্দ্যোপাধ্যায় বাটীতে নিত্য পূজিতা হচ্ছেন গত প্রায় ২৩০ বছর ধ’রে। কালক্রমে কালিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহিষাদল-এর রাজার থেকে জমিদারী পান এবং তিনি দোল দুর্গোৎসব শুরু করেন ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দ নাগাদ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য – গঙ্গার পশ্চিম তীরবর্তী সোমরা, সুখড়িয়া গ্রাম অতি প্রাচীন এক জনপদ এবং সেকালে গঙ্গার পূর্ব তীরবর্তী শান্তিপুর, রাণাঘাট, কৃষ্ণনগর -এর সাথে জলপথে যুক্ত ছিল। বিখ্যাত মিত্র মুস্তাফি-রা এই সোমরা সুখরিয়া ও পার্শ্ববর্তী বলাগড়-শ্রীপুর এ অনেক কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন , যথা – হরসুন্দরী , নিস্তারিণী , আনন্দময়ী , ইত্যাদি। এই প্রতিটি মন্দির প্রাচীন বাংলার দেবমন্দির নির্মাণ শিল্পের এক একটি অনন্য উপমা। সোমরা-র গঙ্গাতীরবর্তী সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরও বহু প্রাচীন | কথামৃততে পাওয়া যায় যে স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব একবার নৌকা যোগে এপথে এসেছিলেন এবং এই মন্দিরের মাতৃমূর্তি দর্শন করেছিলেন।
একজটা তারাপূজা
ফিরে আসা যাক তারা মূর্তিতে্। দশমহাবিদ্যার প্রথম রূপ ‘কালী’ , দ্বিতীয় ‘তারা’। তারাপীঠ -এর তারা মূর্তির থেকে বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির মূর্তি সম্পূর্ণ পৃথক | দেবী এখানে একজটা, নীলবর্ণা , খর্বাকৃতি , লোল জিহ্বা , করাল বদনা, ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা , চতুর্ভূজা, সর্পালঙ্কারা । চার হস্তে খাড়া , ছোরা, নীলপদ্ম ও নরকরোটি । প্রতিমা নির্মাণ হয় বাড়ির ঠাকুর দালানে । প্রতিবছর দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন এই পুজো হয় । আজও প্রাচীন পুথি দেখেই পুজো বিধি মানা হয় । পুজোর রীতি মেনে এখনো ১০ কেজি আতপ চালের মহানৈবিদ্যা, কাঁসার বাটিতে নারিকেল জল দিয়ে কারণ বারি, চিংড়ি মাছের ভোগ নিবেদন করা হয় । রয়েছে ‘বলি’ প্রথাও ।পুজোর পদ্ধতি তন্ত্রমতে এবং মন্ত্রতে বৌধ্যা মহাযান তন্ত্রর প্রভাব স্পষ্ট । মূর্তিতে দেবীর আবাহনও ঘটে বিসর্জন পুজোর রাত্রেই করা হয় । মূর্তি বিসর্জন হয় পরের দিন সন্ধ্যায় গঙ্গায়, বেহারাদের কাঁধে চেপে ।
আরও পড়ুন- যন্ত্রে পূজা,কালীযন্ত্র এবং নাশিগ্রামের পদ্ম অলঙ্কৃত নেড়া মা
সাহিত্যিক সুধীর মিত্র মহাশয় এর ‘হুগলী জেলার ইতিহাস’ বইটিতে সোমরা গ্রাম তথা বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ীর কথার উল্লেখ আমরা পাই । বর্তমানে কালিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ষষ্ঠ প্রজন্মর হাত ধরে সোমরা বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ীর পুজো অনুষ্ঠিত হচ্ছে | বেশ কিছু বছর আগেও নদীয়ার শান্তিপুরের শ্যামচাঁদ পাড়ার ‘অন্নপূর্ণা ভবন’ বাড়ী ও তৎসংলগ্ন ঠাকুর দালানটি ছিল তবে শোনা যায় আজ আর সেই বাড়ী নেই । আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে সেখানে সম্ভবত অট্টালিকা গড়ে উঠেছে (যা পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে; তখনও অবশ্য ঠাকুর-দালান ছিল ব’লেই জানা গিয়েছিল; কিন্তু এখন ঠিক নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।)।
একজটা তারাপূজা ও কয়েকটি প্রশ্ন
পারিবারিক নথি থেকে কালিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর পিতা রামমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও পিতামহ রামসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায় এর নাম জানা যায়। তবে বেশ কিছু প্রশ্ন আজও অজানা ;যেমন , কালিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর ঊর্দ্ধ্বতন কোন্ পুরুষ এই পুজো প্রচলন করেন , কেনই বা কালিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় শান্তিপুর থেকে সোমরাতে চ’লে এলেন, তারপর শান্তিপুরের বাড়ী ও সেখানকার পুজোর কী হ’ল ইত্যাদি| পাঠককুলের সন্ধানে এমন কোন তথ্য জানা থাকলে এই প্রশ্নগুলির উত্তর পেতে বড়ই সুবিধা হয়।
ছবি–লেখক
কৃতজ্ঞতা–শোভন রায়
1 thought on “একজটা তারাপূজা ও সোমরার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের ইতিকথা”
সিংহবাহিনী দুর্গা- লক্ষ্মী সরস্বতী না থাকলেও কার্তিক গণেশ আছে!
(22nd December 2020 - 8:18 am)[…] আরও পড়ুন- একজটা তারাপূজা ও সোমরার বন্দ্যোপাধ্য… […]
Comments are closed.