ম্যাকলাস্কিগঞ্জ- বড়দিন ও কিটি মেমসাবের করুণ কিস্যা।এখানে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বিশাল পরিত্যক্ত ইংলিশ কটেজগুলি , কিছু তার নাম মাত্র মূল্যে হাতবদল হয়েছে, বেশীর ভাগ কেয়ারটেকার নামক জবরদখলকারীদের হাতে। আর আছেন কিটি মেমসাবের মতন হাতগুনতি কয়েকজন এঙ্গলো অধিবাসী ও তাঁদের পরিবার। লিখছেন–ডা.তিলক পুরকায়স্থ।

এঙ্গলো ইন্ডিয়ান
ছোট্ট করে এখানকার এবং সামগ্রিক ভাবে এঙ্গলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের সম্মন্ধে কিছু নির্জলা সত্যি কথা জানাই। কথা হচ্ছে এঙ্গলো ইন্ডিয়ান কারা ? সাদামাটা ভাবে বলা যায় মিশ্র রক্তের ইউরোপিয়ান( পড়ুন ইংরেজ পিতা) এবং এশিয়ান ( পড়ুন ভারতীয় মাতার) সঙ্কর জাত ইউরেশিয়ান সম্প্রদায় যারা জন্মেছিল ভারতে, ধর্মে ছিল খ্রিস্টান এবং মাতৃভাষা ছিল ইংরেজী।
যেহেতু এরা দেখতে অনেকাংশে ইউরোপিয়ানদের মতন, ভাষা ও ধর্ম ভিন্ন ছিল , তাই ভারতীয়রা তাঁদের আপনজন বলে কখনও স্বীকার করেনি।কিন্তু কেন এই বৈষম্য ? স্বাধীনতার পূর্বোত্তর থেকে স্বাধীনতা পরবর্তীতেও দেশ ও দশের উন্নয়নের কাজে অসংখ্য ফিরিঙ্গির অবদান আছে। যেমন হেনরী লুই ডিরোজিও, জেমস কিড(যাঁর নাম থেকেই কিডের পুর বা খিদিরপুর), লেসলী ক্লডিয়াস, ফ্রাঙ্ক এন্থনী, রজার বিন্নী, কার্লটন চ্যাপমান, উইলসন জোন্স এবং এরকম আরো অনেকেই আছেন।বেশি পিছনে যাবার দরকার নেই, স্বাধীন ভারতের প্রথম অলিম্পিক গোল্ড আসে লন্ডন অলিম্পিকে, ১২ ই আগস্ট, ১৯৪৮ এ, ফিল্ড হকি থেকে, ৪-০ গোলে ব্রিটেন কে হারিয়ে।
সেই খেলা নিয়ে তৈরি গোল্ড সিনেমা তো দেখেছেন, কিন্তু জানেন কি, সেই টিমে সর্বমোট ৯ জন এঙ্গলো ইন্ডিয়ান প্লেয়ার খেলেছেন। ফাইনালে বলবীর সিং দুটি গোল করেন। বাকি দুটি গোল করেন দুই এঙ্গলো ইন্ডিয়ান খেলোয়াড় জ্যানসেন এবং পিন্টো একটি একটি করে। আর হকিতে বিলাসপুর/ কলকাতার লেসলি ক্লডিয়াসের তিনটি সোনা এবং একটি রুপোর মেডেল জয়ের রেকর্ড হকির জাদুগর ধ্যানচাঁদেরও নেই।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার ছিল, খাঁটি ইংরেজরা এঙ্গলো দের সঙ্গেও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের মতন ব্যাবহার করতেন।ইউরেশিয়ান দের নিয়োগ করা হতো রেল, খনি, পোস্ট অফিস ইত্যাদি চাকরিতে, কিন্তু খাঁটি ইংরেজরা সামাজিক বিত্ত এবং সম্মানের প্রশ্নে যোজন দূরত্ব বজায় রাখতেন ইনাদের সঙ্গে। বন্ধুবর অমিতাভ পুরকায়স্থ চমৎকার বলেছেন- ” শাসক ও শাসিতের মধ্যে যে দৃঢ় সামাজিক ভেদরেখা তৈরি করতে চাইছিলেন ব্রিটিশ শাসকেরা, তা বারবার গুলিয়ে যাচ্ছিল এই মিশ্র রক্তের জনগোষ্ঠীর জন্য”। অর্থাৎ এদের ট্রাজেডি ছিল- এরা না ঘরকা, না ঘাটকা।
ম্যাকলাস্কিগঞ্জ
কোথা থেকে কোথায় চলে গেছি ! ফিরে আসি আবার ম্যাকলাস্কিগঞ্জে।সময়টা ১৯৩৩ সাল, একজন কলকাতার এঙ্গলো ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক, (যাঁর পিতা আইরিশ ও মাতা ভারতীয়) জমি/বাড়ির ব্যাবসায়ী আর্নেস্ট টিমথি ম্যাকলাস্কির মনে হয় – ইংরেজদের অনুগ্রহে দ্বিতীয় শ্রেণীর অধিবাসী হয়ে বেঁচে থাকা আর পোসাচ্ছে না । এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য ! বরং জন্মভূমি ভারতকেই মাতৃভূমি হিসাবে মেনে নিয়ে, এখানেই যদি ভারতীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে একটা হোমল্যান্ড তৈরি করা যায় – তবে কেমন হয় ? অন্যান্য ফিরিঙ্গীদের সঙ্গে অনেক শলা পরামর্শের পরে ঠিক হোল যেহেতু দামোদর অববাহিকায় কয়লাখনিতে, ছোটনাগপুর মালভূমির খনিজসম্পদ পূর্ণ খনিগুলিতে এবং বেঙ্গল নাগপুর রেলে প্রচুর পরিমাণে এঙ্গলো ইন্ডিয়ান কাজ করে এবং তাঁরা বহুদিন ধরে এখানে বসবাসের ফলে এখানকার আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার সম্মন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।
তাই এতদঞ্চলে যদি জায়গাজমি নিয়ে এঙ্গলো ইন্ডিয়ানদের জন্য হোমল্যান্ড তৈরি করা যায় তবে কেমন হয় ! অনেক কথাবার্তার পরে রাঁচির কাছে রাতুর ৬১তম রাজা – “মহারাজ প্রতাপ উদয় নাথ সাহি দেও”র(১৮৬৬-১৯৫০) কাছ থেকে দীর্ঘ মেয়াদী লিজে খালানি ব্লকে দুলি, রামডেজ্ঞা,হাড়হু, লাপরা, কঙ্ক, মহুলিয়া, হেসালং, মায়াপুর এবং বাসেরিয়া এই ৯ টি গ্রামের প্রায় দশ হাজার একর পতিত জমি নেওয়া হলো।

ম্যাকলাস্কিগঞ্জ ও ফিরিঙ্গি বসতি
খালানি ব্লকে তখন চতুর্দিকে শাল, শিমুল, পলাশ, মহুয়ার জঙ্গল। আর ছিল অসংখ্য আম, জাম , কুল, লিচু, আতা, মহুয়া ইত্যাদি ফলের গাছ। ওই পতিত জমিতে কোথা থেকে এত আমগাছ জন্মেছিল কে জানে ! আবার গাছেদের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে এক তন্বী সুন্দরী – আদিবাসীদের দেওয়া নাম তার ডুগাডুগি নদী। গাছেরা সেই নদীর জলে তাদের ছায়া দেখে। একবার দেখেই ম্যাকলাস্কি সাহেবের দিলখুশ। সঙ্গীদের ও মনে আনন্দ, নিজেদের হোমল্যান্ড হবে।কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোল- OUR” HOME SWEET HOME” , বিজ্ঞাপন দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কত ইমোশন জড়িয়ে ছিল এর সঙ্গে।আরও লেখা ছিল, ম্যাকলাস্কিগঞ্জ আমাদের ” MOOLUK” – অর্থাৎ মানসিকভাবে ফিরিঙ্গিরা তখনই বুঝে গেছে, এই দেশে থাকতে গেলে ইংরেজির সঙ্গে সঙ্গে হিন্দিও শিখতে হবে।
The Colonization Society of India Ltd., 75/ P, Theater Road এ অফিস এবং কোপারেটিভ সোসাইটির পত্তন করা হলো। সোসাইটির শেয়ার কিনলে তবেই ম্যাকলাস্কিগঞ্জে জায়গা পাওয়া যেত। গর্ব করে বিজ্ঞাপন বেরোল- ” Our Home is McCluskiegunge and India is our Motherland”. আস্তে আস্তে গড়ে উঠতে লাগলো ম্যাকলাস্কি সাহেবের স্বপ্নের ” Little England”. বিশাল জায়গা জুড়ে ইউরোপিয়ান স্থ্যপত্যে তৈরি হতে লাগল কত বাংলো। স্থানীয় লোকজনের মুখে মুখে সেগুলো হয়ে দাঁড়াল- পারকিন্স সাহেবের বাংলো, ক্যামেরুন সাহেবের বাংলো( পরে হাইল্যান্ড গেস্ট হাউস), গর্ডন সাহেবের বাংলো, মিলার সাহেবের বাংলো ইত্যাদি।কিন্তু ম্যাকলাস্কিগঞ্জ বোধহয় শুরু থেকেই অভিশপ্ত।
ম্যাকলাস্কিগঞ্জ ও ম্যাকলাস্কি সাহেব
নইলে স্রষ্টা ম্যাকলাস্কি সাহেব মাত্র দু বছরের মধ্যে কেন ধরাধাম থেকে বিদায় নেবেন। ১৯৩৫ এ উনি মারা যাবার পরেও একে একে অনেকেই এখানে জমি বাড়ি করে থিতু হন। বছর দশকের মধ্যে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ জমজমাট। প্রায় ৩০০ পরিবারের বাস। এবাড়ি ওবাড়ি যাতায়াত, পার্টি, সপ্তাহান্তের নাচ-গান, ডুগাডুগি নদীর ধারে পিকনিক, বেশ চলছিল জীবন।দুটি চার্চ, একটি ক্লাব, একটি পোস্ট অফিস, ঘোড়ার আস্তাবল, হাঁস মুরগির খামার সে এক দারুন মিনি ইংল্যান্ড। কিন্তু ফিরিঙ্গি সাহেবেরা যতটা ইমোশনালি যুক্ত ছিলেন ‘ লিটিল ইংল্যান্ড’ নিয়ে, ঠিক ততটা বাস্তববোধ নিয়ে বোধহয় কলোনির ভবিষ্যৎ চিন্তা করেন নি।
বাজার, হাট, সিনেমা, থিয়েটার, হাসপাতাল, ডিস্পেন্সারি, কোন কিছুই তখনও ছিল না, এখনও নেই। আজকেও ম্যাকলাস্কিগঞ্জ সেই ৮০ বছর আগেকার গঞ্জই রয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে কোন চাকরির সুযোগ নেই। বাগানের ফল ফুল বেচবার জন্য কোন বাজার গড়ে ওঠেনি। সড়ক পথের অবস্থা শোচনীয়। স্টেশন একটা আছে বটে, কলকাতা থেকে একটি মাত্র ট্রেন শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস প্রায়ই মাঝরাতে এসে পৌঁছায়। আর আসে পাটনা থেকে পালামু এক্সপ্রেস। বাকি সব স্থানীয় লোকাল ট্রেন। ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিং এবং মাওবাদীদের উপদ্রব , কিছুদিন আগেও ছিল এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা।

কিটি মেমসাব
আর আমরা যতই গান গাইনা কেন- শক হন দল পাঠান মোগল একদেহে হোল লিন- এই ফর্সা, কটা চোখের ট্রেনের ড্রাইভার/ গার্ড/ কলিয়ারীর ওভারম্যান/সওদাগরি অফিসের টাইপিস্ট বা পি এ দের কখনও অন্তর থেকে আপন করে নিতে পারিনি, আমাদের চোখে এই হতভাগ্য লোকগুলি কলোনিয়াল যুগের প্রতিভূ। সেজন্য একদা যে লোকগুলি নিজেদের মুলুক তৈরি করেছে ভারতে, সগর্বে বলেছে ইন্ডিয়া ইজ আওয়ার মাদারল্যান্ড, প্রথম অলিম্পিক গোল্ড মেডাল অর্জনে যাঁদের বিশাল ভূমিকা ছিল, তাঁরা কিন্তু ততদিনে পরিষ্কার বুঝে গেছে এদেশে এখনও তাঁরা অবাঞ্ছিত। রাজনৈতিক ও সামাজিক পালাবদলের ঝড় এই মানুষগুলির পক্ষে শুভ সংকেত বয়ে আনেনি। এরই নিটফল আজকের খন্ডহর ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। আর কিটি মেমসাহেব( Kitty Texeira) হচ্ছেন এখানকার দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাসের জীবন্ত দলিল।
বর্তমান অবস্থা
একদা বসবাসকারী ৩০০টি পরিবারের মধ্যে টেনে টুনে খান কুড়ি পরিবারও এখন এখানে থাকে কিনা সন্দেহ। অনেক বিখ্যাত বাঙালিও সাহেবদের পরিত্যক্ত বাংলো কিনেছিলেন, কিন্তু বেশিদিন রাখতে পারেন নি। মহেশ্বেতা দেবী , বুদ্ধদেব গুহা, অপর্ণা সেন অনেকেই এখানে বাড়ি কিনেছেন।ইন ফ্যাক্ট, ম্যাকলাস্কিগঞ্জের সঙ্গে আমার প্রথম প্রেমের সূচনা বুদ্ধদেব গুহর – একটু উষ্ণতার জন্য-র হাত ধরে।পরে জেনেছিলাম ওখানে উনার একটি চমৎকার বাড়ি ছিল। উনার মায়ের নামে বাড়িটির নাম দিয়েছিলেন- মন্জুলিকা। ১৯৬২ সালে উত্তমকুমার ও অরুন্ধতী দেবী অভিনীত ছবি ‘শিউলিবাড়ি’ র শুটিং এখানে হয়েছিল।অপর্ণা সেনের মেয়ে কঙ্কনা তাঁর বাবা মুকুল শর্মার গল্পের ওপরে ভিত্তি করে ২০১৬ তে একটি চমৎকার ছবি বানিয়েছেন- A Death in the Gunj.পারলে ছবিটি দেখবেন।
১৯৯৭ সালে পাটনা নিবাসী M L C শ্রী আলফ্রেড জর্জ ডি’রোজারিও এখানে Don Bosco Academy প্রতিষ্ঠা করলে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের দুর্বল শরীরে কিছু পরিমানে রক্ত সঞ্চালন শুরু হয়েছে।এই স্কুলের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে, সারা ঝাড়খন্ড, বিহার থেকে ছাত্রভর্তি হয়। কিন্তু রোজারিও সাহেবের মাস্টার স্ট্রোক হচ্ছে, হোস্টেল বিল্ডিং না বানিয়ে স্থানীয় এঙ্গলো ইন্ডিয়ান দের সুযোগ করে দেওয়া হয় হোস্টেল বানাবার জন্য যাতে করে আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়।তাছাড়া রোজারিও সাহেবের শ্বশুর বাড়িও এখানেই।
কিন্তু মানুষ তো আশা নিয়েই বাঁচে। এখনও ম্যাকলাস্কিগঞ্জের টি আর পি খুব ভারী। কেন বলুন তো- এর আসমানী নীল আকাশ, সকাল সন্ধ্যায় সোনার বরণ সুয্যি ঠাকুরের অবাধ যাতায়াত , আর নীচে ঘন সবুজের মাতাল সমুদ্রের জন্য । ম্যাকলাস্কিগঞ্জ একদিন বেড়াতে আসার জন্য নয়,বেশ কিছুদিন থাকার জন্য, আত্মউপলব্ধির জন্য । এর আকাশে বাতাসে মনখারাপের জন্য মৃতসঞ্জীবনি সুধা ছড়িয়ে আছে। গলায় গান থাকুক আর নাই থাকুক, মন গেয়ে উঠবেই-
ও আকাশ সোনা সোনা, এ মাটি সবুজ সবুজ
নতুন রঙের ছোঁয়ায় হৃদয় রেঙেছে,
আলোর জোয়ারে খুশির বাঁধ ভেঙেছে।
ম্যাকলাস্কিগঞ্জ মিনি ইংল্যাণ্ড
তাহলে আর দেরি কেন, চলুন বেড়িয়ে পড়ি মিনি ইংল্যান্ড দর্শনে।থাকবেন কোথায় ? যদি অরণ্যের দিনরাত্রি আপনার ঠিকানা করতে চান তবে অবশ্যই আসবেন এঙ্গলো ইন্ডিয়ান ঠিকানায়। সব তো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে, জঙ্গলে গিয়েও এসি ঘর এবং আনুষঙ্গিক বস্তু চাইলে যা হবার তাই হচ্ছে। উষাঞ্জলি অনেক আগেই বন্ধ, হাইল্যান্ড ও বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ হাইল্যান্ড নিজেই তো এখানকার চলমান ইতিহাস- একসময়ের ম্যাকলাস্কিগঞ্জের একমাত্র গেস্ট হাউস- কার্ণে সাহেবের বাংলো, হাত বদলে ক্যামেরুন তারপর হয় হাইল্যান্ড। আজ এই ইতিহাস ধ্বংস হতে চলেছে।এখন অবধি বেঁচে আছে ৺ নেলসন পল গর্ডন এর তৈরি , বর্তমানে তাঁর পুত্র ববি গর্ডন পরিচালিত গর্ডন হোস্টেল & গ্রিনল্যান্ড গেষ্ট হাউস টি। যদি বেসিক জিনিষ নিয়ে খুশি থাকতে পারেন তবে অসাধারণ অভিজ্ঞতা হবে ববি গর্ডনের গেষ্ট হাউসে থাকলে।
২০১৮ র নভেম্বর মাসের এক দুপুরে গিয়েই একচক্কর হাঁটতে বেরোলাম স্টেশনের দিকে।এই স্টেশনের ছবি এবং এখানের প্লাটফর্মে বসে এক- কটা চোখের গোরা সুন্দরী ঝুড়ি নিয়ে জাম বিক্রি করছেন, কলেজ জীবনে আমেরিকার Time ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে দেখা ছবিটা মনে এখনও দাগ কেটে রয়েছে। উনার নামটাও মনে আছে- কিটি মেমসাব, আসল নাম Catherine Texeira। ববির কাছে জেনেছি কিটি এখনও ছোট মেয়েকে নিয়ে ঘোর জঙ্গলের মধ্যে ঘর বানিয়ে বাস করে।
পথের পাঁচালী
বর্তমানের ম্যাকলাস্কিগঞ্জ একেবারে এক বিহারী দেহাত। স্টেশনের কোথাও দেওয়ালে বা বোর্ডে একবর্ন ইংরেজি লেখা চোখে পড়ল না, যদিও আমরা গেছি মিনি ইংল্যান্ড দেখতে। রাস্তাঘাট যেমন, রেল কলোনির চেহারাও তেমনি। গলা অবধি দীর্ঘ ঘাস, রেল লাইনের দুধারে। তবুও স্টেশনটিকে একনজরে দেখেই ভালো লেগে গেল। শুনশান বিষন্ন স্টেশন কিন্তু তবুও কি রোমান্টিক! স্টেশনের ওভারব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে বহুদূরের দিগন্ত বিস্তৃত শৈলশিরার সারি আর ঘন সবুজে ঢাকা ধরিত্রীর আঁচল বিছানো শাড়ির রূপ তন্ময় হয়ে দেখছিলাম। এরমধ্যে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে একটি ট্রেন এসে দাঁড়াল। হলই বা মালগাড়ি, স্টেশনের একপ্রান্তে দাঁড়ান ছোট্ট মেয়েটি অপলক দৃষ্টিতে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওই তো সেই পথের পাঁচালির দুর্গা!
ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে, খেয়ে দেয়ে আবার বেরোতে হবে।পথে পড়ল দেহাতি দোকানপাট, শিবমন্দির, পোষ্ট অফিস। আর আছে ডন বস্ক স্কুলের অসংখ্য ছোট ছোট পেয়িং গেস্ট হোস্টেল।
লাঞ্চ করে একদৌড়ে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের সুন্দরতম জায়গা ডুগা ডুগি নদীতে।ছিপছিপে তন্বী, কিন্তু কি তার রূপ। ছোট নদীর ওপর ছোট একটা লাল মোরাম ঢালা সেতু। একদিকে গাছেদের দীর্ঘ ছায়া পড়েছে নদীর জলে, আর ছায়ায় ঢাকা সেই ঠান্ডা জলে কত ছোট ছোট মাছ।বিশ্বাস করুন আমরা তখন সবাই অরণ্যের দিনরাত্রির এক একটি চরিত্র হয়ে গেছি।আর এত দূষণবিহীন নীল আকাশ শেষ কবে দেখেছি জানিনা, শুধু কি তাই, মাথার ওপর সূর্য্যদেব কে দেখছি, আবার একটু দূরেই সাদা শাড়িতে চন্দ্রাবতী দেবী উপস্থিত ভর দুপুরে। যেন যোগিন সরকারের কবিতা, বিস্ময়ে হতবাক আমরা সবাই।

জাগৃতি বিহার
এখান থেকে বেরিয়ে জাগৃতি বিহার। বলা যেতে পারে Nature’s interpretation center. ভিতরে ঢুকলে মনে হবে কিচ্ছু তো দেখবার নেই, খালি আকাশ ছোঁয়া গাছের সারি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই হচ্ছে এখানকার সম্পদ- আবার অরণ্যে। আর এই অরণ্যের শেষ প্রান্তে জাগৃতি বিহারের যে বাড়িটি দাড়িয়ে আছে, হলফ করে বলা যায়, ঘন জঙ্গলের পটভূমিকায় এমন অপূর্ব সুন্দর শিল্পগৃহ খুব কমই দেখতে পাবেন।
খোঁজ করে গেলাম Malcolm Hourigan এর বাড়িতে। ম্যাকলাস্কিগঞ্জ নিয়ে উনার অনেক সুন্দর লেখা পড়েছি।একটা লেখার নাম বলছি – Probashionline.Com এ বেরিয়েছিল- Holding On: The Anglo Indian Settlement in McCluskiegungj. এই লেখাটিতে উনার প্রবন্ধের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। প্রাচীন এঙ্গলো সমাজ এবং সেযুগের অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি দেওয়া আছে লেখাটিতে। ইচ্ছা ছিল উনার জ্ঞানভান্ডার থেকে কিছু সংগ্রহ করব এবং প্রাচীন ম্যাকলাস্কিগঞ্জের ছবি দেখব ।কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, উনি বাড়ি ছিলেননা।
ফিরে আসা গর্ডন গেষ্ট হাউসে। ববির মা যখন গল্পের ঝুলি খুললেন, তখন আর আমাকে পায় কে ! সেই ১৯৪৫ সালে বাড়ি তৈরির সময় থেকে আজ অবধি, কত কিছু পরিবর্তন এর গল্প। এর সঙ্গে আছে চিতাবাঘ বা নেকড়ে বাঘ এর হানার গল্প। বিকেল বেলায় পোষ্ট অফিস যাওয়া হত চিঠি আনতে,কিন্তু সঙ্গে থাকতো আগ্নেয়াস্ত্র, চিতা বাঘের ভয়ে। মাথার ওপরে পূর্ণ চাঁদ আর বিশাল বাগানের এক কোনায় টিমটিমে বাল্বের আলোতে সে গল্প শোনা এক অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা।
কিটির বাড়ি
পরের দিন সকালে উঠে এক ধাক্কায় যেন বয়সটা ৫০ বছর কমে গেল। আমি যেন আর সেই আমি নই, পথের পাঁচালির অপু হয়ে গেছি। লাফাতে লাফাতে চলেছি স্টেশনে। সকালের পালামৌ এক্সপ্রেস ট্রেনটি দেখতেই হবে। ট্রেন এলো, হুইসেল বাজিয়ে চলেও গেল, শুনশান এই পরিবেশে সে যে মনের মধ্যে কি এক আশ্চর্য বেদনার সৃষ্টি করল কি বলব! অথচ কিসের দুঃখ তাও ঠিক জানি না। খুব আশা করেছিলাম হয়তো কিটি মেমসাবকে ফলের ঝুড়ি হাতে দেখতে পাবো। কিটি মেমসাব আর আজকাল ফল নিয়ে আসেন না শুনলাম। হেঁটেই চললাম কিটির বাড়ি, একে তাকে জিজ্ঞেস করতে করতে। কিটি ম্যাকলাস্কিগঞ্জের মুখ,অতিশয় গরিব, দিন দরিদ্র কিন্তু সারা পৃথিবীর সংগ্রামী নারীদের অন্যতম প্রতিনিধি।নইলে কি আর টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ছবি ছাপা হয়!
প্রায় তিন কিলোমিটার পথ ঠেঙিয়ে, ধানজমির আলের ওপর দিয়ে, জঙ্গলের মধ্যে পায়ে চলা পথের নিশানা ধরে, চারদিকে ঘন গাছপালার মধ্যে দিয়ে পৌঁছুলাম কিটি মেমসাহেবের বাড়িতে। হত দারিদ্রদের চিন্হ সর্বত্র। কিন্তু এই দারিদ্র লজ্জার নয়, গর্বের।কথা বলব কি, সামনে দেখছি জীর্ণ দেহাতি সস্তা মিলের শাড়ি পরে এক অগ্নিশিখা জ্বলছেন।কে বলেছে নারী জীবনের সার সত্য- পরাধীনতার ? বংশধারা বজায় রাখাই তাঁর প্রধান কাজ। এই নারী তো সারা জীবনেও তাঁর ভাগ্যকে বিড়ম্বনা বলে ভাবেন নি। হৃদয়ের বেদনা, রক্তক্ষরণ লুকিয়ে রেখে এই ৬৬ বছর বয়সেও বাগান করা, ফসল ফলানো , আম, জাম, লিচু, মহুয়া গাছের ফল বিক্রি করা, ছাগল মুরগি পালন, জঙ্গলে ঝাঁটি লকরি কুড়িয়ে এনে উনুন জ্বালানো, মেয়েদের মানুষ করা- সবকিছু অক্লান্ত পরিশ্রমে করে চলেছেন। সঙ্গে আছে মেয়ে সিলভিয়া এবং নাতনিকে নিয়ে । সিলভিয়া টিউশনি করে মাকে সাহায্য করছে। বিভিন্ন হোস্টেলে গিয়ে ছেলে মেয়েদের পড়ায়।বাচ্চা মেয়েটি যে কি মিষ্টি, আর কি শান্ত- কি বলব !
উনার প্রচুর জায়গা ঝাড়খণ্ড সরকারের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট নিয়ে নিয়েছে, সেই নিয়ে উনার কোন অভিযোগ নেই। কারো ব্যাপারে বা কোন ব্যাপারেই কোন অভিযোগ বা অনুযোগ করলেন না।সবই উনার মতে ডেসটিনি।এমন কি গুটি কয়েক চোর ডাকাতের গল্প করেও এই ব্যাপারে উনার শেষ অভিমত, এই মানুষগুলি এত গরিব, ওদের পেট চালানোর জন্যই অনেকসময় বাধ্য হয়ে এসব করে।
বড়দিন
ম্যাকলাস্কিগঞ্জের ইতিহাস ভূগোল সব উনার নখদর্পনে। গরগড়িয়ে বলে চলেছেন এখানকার উত্থান/পতনের কথা।আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি।এত কষ্টের মধ্যেও এঙ্গলো ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের ও পঞ্চায়েতের কাজকর্মে নিজেকে নিযুক্ত রেখেছেন। মাঝে মাঝে এবং অবশ্যই বড়দিনে চার্চে যান, কিন্তু প্রার্থনা সেরেই সিধে নিজের ঘর।
আরও পড়ুন- নাস্তিক পন্ডিতের ভিটায়-বাংলাদেশের বজ্রযোগিনী গ্রামে
ঘরের মধ্যে থেকে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট একটি ছবি নিয়ে এসে দেখালেন আমাদের। মান্ডলীন বাজাচ্ছেন উনার দাদুর ভাই। আর আগলে রেখেছেন স্বর্গীয় মায়ের একটি কমবয়সী ভারী মিষ্টি ছবি। মায়ের নাম শুনলাম মাধুরী ট্রেক্সসিএরা।ওঁরা থাকতেন আসামে। আগেই শুনেছি যে উনি স্থানীয় এক আদিবাসীকে বিবাহ করে সাহেবি ম্যাকলাস্কিগঞ্জ ছেড়ে এই ঘন জঙ্গলে স্বেচ্ছায় বনবাস জীবন বেছে নিয়েছেন। এত দারিদ্র্যের মধ্যেও চা খাবার অনুরোধ করলেন। সবিনয়ে এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে নমস্কার করে বেরিয়ে এলাম।মন এক অসাধারণ তৃপ্তির আনন্দে ভরপুর। ম্যাকলাস্কিগঞ্জ আসা সার্থক।
(তথ্যসূত্র ও ঋণ স্বীকার: 1)খিদিরপুরের কিড সাহেব, amitava.wordpress.com/2017/08/08
2)Holding On : The Anglo Indian Settlement in McCluskiegunj | Probashi, www.probashionline.com
3)McCluskieganj: Saga of an aborted dream – The Pioneer
https://www.dailypioneer.com › miscellany
4)McCluskieganj – Wikipedia
https://en.m.wikipedia.org › wiki › McCl…)]
Facebook Comments