
“দক্ষিণ কাশী” সংক্রান্ত আলোচনায় আমরা যে তিনটি নাম পাই (তেনকাশী, প্রকাশা ও শিবকাশী), তার মধ্যে তেনকাশী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আজ প্রকাশা নিয়ে আলোচনা করা হবে। লিখছেন–আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়।
প্রকাশা দক্ষিণ কাশী
মহারাষ্ট্রের নন্দুরবার জেলার শাহাদা তালুকে তাপ্তী নদীর পাড়ে অবস্থিত প্রকাশাকেও “দক্ষিণ কাশী” বলা হয়। এখানে ১০৮টি শিবমন্দির আছে, যার মধ্যে শ্রীপুষ্পদন্তেশ্বর, শ্রীকেদারেশ্বর ও শ্রীকাশী বিশ্বেশ্বর মন্দির বিখ্যাত। প্রকাশার ভৌগোলিক কো-অর্ডিনেট ২১.৩ ডিগ্রী নর্থ, ৭৪.১ ডিগ্রী ইস্ট।
প্রকাশার খুব কাছেই তাপ্তী ও গোমাই নদীর সঙ্গম, যদিও স্থানীয় লোকেরা বলেন তৃতীয় একটি নদীও (পুলোন্দা) ঐ সঙ্গমে মিলে সঙ্গমটিকে একটি ত্রিবেণী সঙ্গমে পরিনত করেছে। গোমাই নদীকে স্থানীয় লোকেরা অনেক সময় গোমতী বলে উল্লেখ করেন। সাতপুরা পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে গোমাই নদী প্রকাশার ২ কিলোমিটার পূবে তাপ্তীর সঙ্গে মিলিত হয়।
এখানে ত্রিবেণী সম্বন্ধে একটু আলোচনা করলে খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে হয় না।

তিন নদীর সঙ্গম ত্রিবেণী
ত্রিবেণী অর্থে তিনটি নদীর সঙ্গম। হিন্দু ধর্মে ত্রিবেণী সঙ্গমকে খুবই পবিত্র মানা হয় এবং প্রতিটি ত্রিবেণী সঙ্গমই বড় তীর্থক্ষেত্র্র। সারা ভারতে ত্রিবেণী সঙ্গমের সংখ্যা খুব বেশি নয় এবং যেগুলি আছে তার অনেকগুলিতেই তৃতীয় নদীটি অদৃশ্য বা অন্তঃসলিলা (সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল প্রয়াগরাজ বা এলাহাবাদ, যেখানে দৃশ্যমান গঙ্গা আর যমুনার সঙ্গে অন্তঃসলিলা সরস্বতীর সঙ্গম)। আরও চারটি বিখ্যাত ত্রিবেণী সঙ্গম হল গুজরাটের সোমনাথের ত্রিবেণী সঙ্গম (হিরণ, কপিলা আর সরস্বতীর সঙ্গম), কর্ণাটকের ব্যাঙ্গালুরু থেকে ১৩৫ কিলোমিটার দূরের তিরুমাকুডালু (সংক্ষেপে টি.) নর্সিপুরা (কাবেরী, কাবিনী ও অদৃশ্য গুপ্তগামিনীর ত্রিবেণী সঙ্গম), ছত্তিসগড়ের রাজধানী রায়পুর থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরের রাজিম (মহানদী, পৈরী ও সোন্দুর নদীর ত্রিবেণী সঙ্গম ; এখানে তিনটি নদীই দৃশ্যমান) এবং এই মহারাষ্ট্রের প্রকাশা, যাকে দক্ষিণ কাশীও বলা হয়।
সোমনাথ, টি. নর্সিপুরা, রাজিম ও প্রকাশা চারটি জায়গাই গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান এবং ঘটনাক্রমে টি. নরসিপুরা, রাজিম ও প্রকাশা এই তিনটি জায়গাতেই ‘কুম্ভ’ মেলা হয়, যার মধ্যে রাজিম কুম্ভকে বলা হয় পঞ্চম কুম্ভ।

ব্যারেজ
প্রকাশায় তাপ্তী নদীর উপর ২০০৮ সালে একটি ১৪৪৩ মিটার লম্বা এবং ২৭টি গেট-ওলা ব্যারেজ বানানো হয়েছে। এই ব্যারেজের রিজার্ভারের জলধারণ ক্ষমতা ২.২৪ TMC। এই জলাধারে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় এবং এর জল থেকে ৮৮৫৬ হেক্টার জমিতে জলসেচন করার ব্যবস্থা আছে।
প্রকাশা একটি অতি প্রাচীন জায়গা। ASI (Archeological Survey of India) এখানে গোমাই নদীর ধারে এবং গোমাই-তাপ্তীর সঙ্গমের কাছে খননকার্য চালিয়ে বিভিন্ন যুগের মনুষ্যসভ্যতার হদিশ পেয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনটি খৃঃ পুঃ ১৭০০ – ১৩০০ সালের তাম্র-প্রস্তর (Chalcolithic) যুগের। দ্বিতীয়টি হল খৃঃ পুঃ ৭০০ – ১০০ সালের লৌহ যুগের। তৃতীয় যুগটি হল খৃঃ পুঃ দ্বিতীয় শতক থেকে খৃষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের। এরপরেও এই অঞ্চলে মনুষ্যবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে।প্রকাশা সম্বন্ধে এত কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য, জায়গাটি যে শুধু কতগুলি মন্দিরের সমষ্টিমাত্রই নয়, তা বোঝানো।

প্রকাশা : গুরুত্বপূর্ণ মন্দির
তাপ্তী নদীর পাড়ে একটি টিলার উপর পাশাপাশি দু’টি বড় শিবমন্দির – শ্রীকেদারেশ্বর ও শ্রীকাশীবিশ্বেশ্বর। দু’টি মন্দিরের সামনেই পাথরের হাঁটুগেঁড়ে বসা নন্দীমূর্তি। পাশে অন্নপূর্ণা মন্দিরও আছে। মূল মন্দিরের দিকে মুখ করলে বাঁদিকে একধাপ নীচে পিত্রুশ্বর মন্দির যার মধ্যে পারলৌকিক কাজ করা হয়।
এই টিলাটির পিছনে আরও প্রায় ১৫০ মিটার দূরে তাপ্তী নদীর পাড়ে দ্বিতীয় একটি অনুচ্চ টিলার উপর পুষ্পদন্তেশ্বর শিবমন্দিরটি অবস্থিত।
এই মন্দিরটির নামকরণের একটি সুন্দর কাহিনী আছে। পুষ্পদন্ত নামের একজন গন্ধর্ব (তাঁর ফুলের মত সুন্দর দাঁতের জন্যই তাঁর নাম ছিল পুষ্পদন্ত) এই মন্দিরে প্রতিদিন ১০৮টি সাদা রঙের ফুল দিয়ে শিবপূজা করতেন। একদিন শিব পুষ্পদন্তের ভক্তির গভীরতা পরীক্ষা করার জন্য একটি ফুল লুকিয়ে রাখেন। পুষ্পদন্ত পূজা করতে বসে দেখেন যে একটি ফুল কম পড়ছে। অন্য কোনও উপায় না পেয়ে পুষ্পদন্ত নিজের ফুলের মত সুন্দর একটি দাঁত তুলে তাই দিয়ে তাঁর পূজা সম্পূর্ণ করলেন।

লোককাহিনী
পুষ্পদন্তের ভক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে শিব তাঁকে দর্শন দিয়ে আশীর্বাদ করেন এই বলে যে প্রকাশায় এই মন্দিরে তিনি পুষ্পদন্তেশ্বর নামে চিরকাল অধিষ্ঠান করবেন এবং এখানে একবার পূজা দেওয়া কাশীতে এক হাজারবার পূজা দেওয়ার সমান। শিব আরও বলেন যে এই প্রকাশা ‘দক্ষিণ কাশী’ নামে পরিচিত হবে এবং প্রকাশা দর্শন না করলে কারুর কাশী দর্শন পূর্ণ হবে না।
আরও পড়ুন-– তেনকাশী – অনাহত চক্রের অধীশ্বর কাশী বিশ্বনাথের দক্ষিণকাশী ১
পুষ্পদন্ত এই মন্দিরে বসেই তাঁর বিখ্যাত শিবমহিম্নস্তোত্র লেখেন।স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস এই মন্দিরটির বয়স পাঁচ হাজার বছর এবং এটি পাণ্ডবদের তৈরী। পাণ্ডবরা নাকি এই মন্দিরটি এক রাতের মধ্যে বানিয়েছিলেন। তাঁদের মন্দির তৈরী শেষ হয় আর সূর্যোদয় হয়ে চারদিক আলো (প্রকাশ) হয়ে যায়। সেই থেকেই এই জায়গাটির নাম প্রকাশা।বলাই বাহুল্য এটি পৌরাণিক গল্প। তবে পাথরের তৈরী মন্দিরটি কমপক্ষে আড়াইশো থেকে তিনশো বছরের পুরোনো বলেই মনে হয়। হয়তো হলেও হতে পারে বর্তমান মন্দিরটি প্রাচীন কোনও মন্দিরের উপর বানানো।পাশেই একটি বিশাল বটগাছের তলায় আর একটি ছোট শিবমন্দির, নাম বিল্লেশ্বর।

প্রকাশা : তাপ্তী নদীর জলাধার
আগেই বলা হয়েছে প্রকাশায় তাপ্তী নদীর উপর ২০০৮ সালে একটি ১৪৪৩ মিটার লম্বা এবং ২৭টি গেট-ওলা ব্যারেজ বানানো হয়েছে। এই ব্যারেজের রিজার্ভারের জলধারণ ক্ষমতা ২.২৪ TMC। এই জলাধারে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় এবং এর জল থেকে ৮৮৫৬ হেক্টার জমিতে জলসেচন করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু যে কথাটি বলার এই প্যারাগ্রাফটি লিখছি তা হল গত ১১ নভেম্বর ২০২০ তারিখে নর্মদা পরিক্রমা করার সময় আমি যখন প্রকাশায় যাই, তখন এই জলাধারটির পাড়ে (কিছু আবার জলের মধ্যে আংশিক ডুবন্ত) অজস্র ভাঙা পাথরের মূ্র্তি (অধিকাংশই বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, নন্দী ও শিবলিঙ্গ) পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। এর রহস্যটা কী তা জানতে পারিনি। ওগুলি কি কোনও ভাঙা মন্দিরের অংশ? ইন্টারনেটে কিছু খুঁজে পাই নি।
প্রসঙ্গতঃ, এখানকার পুষ্পদন্তেশ্বর মন্দিরে আমার একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যার ব্যাখ্যা আমি আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে পাইনি। সেই অভিজ্ঞতার কথা আমি আমার ররনর্মদা পরিক্রমা নিয়ে লেখা “বহুরূপে নর্মদা” বইটিতে বিস্তারিত ভাবে লিখেছি।



প্রকাশা : উপসংহার
‘দক্ষিণ কাশী’-র অন্যতম প্রকাশা শিবভক্তদের কাছে একটি বড় তীর্থস্থান। আর আপনি যদি পুষ্পদন্তেশ্বর-শিব উপাখ্যানে বিশ্বাসী হন, তবে তো কাশীদর্শন কমপ্লিট করার জন্য আপনাকে এখানে আসতেই হবে।
ওঁ নমঃ শিবায়।
ঋণ স্বীকার
উইকিপিডিয়া সহ বিভিন্ন ইন্টারনেট সাইট।
ফটো : লেখক
Facebook Comments