সুমনকুমার গায়েনঃবয়স প্রায় সত্তর ছুই ছুই।এই বয়সেও কি নিঁখুত জ্যামিতিক নকশার রেখা মাথায় রেখে নিখুঁত দাগ কেটে চলেছেন প্রিয়বালা মন্ডল! কোজাগরী লক্ষীপুজোয় মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসে বাড়ির উঠোনে লেপা মাটির ওপর আলপনা দিয়ে চলেছেন। তবে যে সে আলপনা নয়। এ হল শতদল পদ্মের আলপনা। “জানোতো,এই আলপনা দিতে হয় এক মন দিয়ে।কোনো রকম কথা বলা যায় না।” খড়িমাটিতে ভেজানো তুলোকে বাটিতে চুবিয়ে নিয়ে মাটির ওপর দুই আঙুল রেখে টান দিতে দিতেই কথাটি বললেন প্রিয়বালা মন্ডল।তার কারণ তিনি একটু হেসে বললেন,” অনেকগুলো ছকের ব্যাপারতো,যদি ভুল হয়ে যায়।”
ওনার আদি বাড়ি পূর্ববঙ্গে।বড়িশালের সাগরদীপে। আপনার মা কি আপনার মতনই আলপনা দিতেন? উওরে তিনি জানালেন, “মা (সরস্বতী হালদার) আমার থেকেও সুন্দর আলপনা করতো।সে দেখার মতন।” পাশে খড়ি মাটি গুলে দিচ্ছেন তার মেজ মেয়ে টুটুল মল্লিক(৪২)।বাতাবি গাছে লেবু ধরে রয়েছে।বিকেলের পড়ন্ত রোদে সেই বাতাবি গাছের ছায়া এসে পড়েছে ঠিক উঠোনের মাঋখানে।ধান সেদ্ধ হওয়া উনোনের কাছে একজোড়া শালিক এসে খুঁজে চলেছে ধান।জীবনানন্দ বেঁচে থাকলে এই দেখে বলতেন,”তবুও কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়। ”
গ্রাম বাংলার আলপনায় আমরা দেখে থাকি, উঠোনের মাঝ বরাবর প্রথমে গোলাকার, চর্তুকোনাকার, ষড়কোনাকৃতি নকশা আঁকা হয়।এইগুলোকে বলা হয় মন্ডল।এই মন্ডলের ভিতরে আটটি পাপড়ি বিশিষ্ট একটি ফুল দেখা যায়। এটি আঞ্চলিক ভেদে অষ্টদল পদ্ম, পানপদ্ম, সোনালপদ্ম,ইত্যাদি নামে পরিচিত।
ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সেন বলছেন- “পানপদ্ম -এই পদ্ম প্রাচীনকাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে।জাপান হইতে ব্যাবলোনিয়া পর্যন্ত ইহার অনুরূপ পদ্ম দৃষ্ট হয়।”
পদ্ম একটি মোটিফ হিসাবে বহুল প্রচলিত।পদ্ম ফুল ঊর্বরতার প্রতীক হিসাবে ব্যাপক পরিচিত।বাংলার মন্ডন শিল্প থেকে কাথাঁ, আসন, চাদোঁয়া,আমসত্ত্বের ছাঁচ ইত্যাদি শিল্পে এই মোটিফ ঘুরে ফিরে আসে।আশ্চর্যের বিষয় উপরের সব কটি শিল্প মহিলাদের হাতে তৈরী।কাজেই মহিলাদের সঙ্গে আলপনার সংযোগ ছিল এবং বর্তমানে এখনও তা আছে।কিন্তু প্রশ্ন হল এই সব নকশা তাঁরা পেল কোথা থেকে!
অন্যদিকে ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ভাস্কর্য এবং তন্ত্র উপাসনায় দেহ মধ্যস্থিত ষট্ চক্রের প্রতিটি পদ্মের দল অথাৎ পাপড়ি নির্দিষ্ট সংখ্যায় ব্যাবহৃত হয়েছে।যেমন-চর্তুদল,অষ্টদল,ষোড়শ দল,শতদল, সহস্রদল ইত্যাদি।প্রত্যেকটি দলের মধ্যে তন্ত্রের বিমূর্ত জ্যামিতিক অববয়ব থাকে।এই জ্যামিতিক অববয়বগুলি পঞ্চতত্ত্বের চিহ্ন স্বরূপ আঁকা হয়।যেমন ক্ষিতি -চতুর্ভুজ, অব-গোলাকার, তেজ-ত্রিভুজাকার, মরু-চন্দ্রাকৃতি।এবং ব্যেম হল জলের ফোঁটার ন্যায়। তন্ত্রে ঊর্ধমুখী ত্রিভুজ হল শিব বা পুরুষ শক্তি।নিন্মমুখী ত্রিভুজ নারী শক্তির প্রতীক হিসাবে বিবেচিত। রসায়নবিদ্যায় এই ত্রিভুজ ডেল্টা নামে পরিচিত। অতএব, উপদেশীয় উপাশনার এই সমস্ত চিহ্ন-প্রতীক জন্মজন্মান্তর ধরে মানুষের অবচেতনীয় মননে রয়েছে। যার বহিঃপ্রকাশ এই সমস্ত মহিলাদের আঁকা আলপনায় দেখা যায়।সেখানে প্রিয়বালা মন্ডল বাদ যাবেন কেন?
তথ্যঋণ
১.দীনেশচন্দ্র সেন- বৃহৎ বঙ্গ,দে’জ,ফাল্গুন ১৯৯৯
২. অবনীন্দ্র রচনাবলী,নবম খন্ড,প্রকাশ ভবন, মাঘ ১৪১৭
৩.জীবনানন্দ দাসের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ভারবি প্রকাশনা।
ছবি-লেখক ও অপূর্ব ব্যানার্জি
Facebook Comments