
ষড়চক্রের অধীশ্বর ‘আথারা লিঙ্গম’-য়ের বিষয়ে লিখতে গিয়ে অনাহত চক্রের অধীশ্বর কাশী বিশ্বনাথের আলোচনা প্রসঙ্গে অরিজিনাল অর্থাৎ বারাণসির কাশীর সঙ্গে “দক্ষিণকাশী” কথাটাও আসে। দক্ষিণকাশী-র খোঁজ করতে গেলে যে তিনটি জায়গার নাম আসে, তার মধ্যে প্রথম নামটি হল তামিলনাড়ুর তেনকাশী (তেন = দক্ষিণ)। অন্য দু’টি নাম হল তামিলনাড়ুরই শিবকাশী এবং মহারাষ্ট্রের প্রকাশা। এর মধ্যে শিবকাশী এখনও আমার দেখা হয়নি, তবে তেনকাশী ও প্রকাশা গিয়েছি, তাই ঐ দু’টি জায়গা নিয়েই বিস্তারিত লিখছি, শিবকাশী আপাততঃ শুধু ছুঁয়ে যাচ্ছি।আজ তেনকাশী। লিখছেন- আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়।
তেনকাশী : অবস্থান
তামিলনাড়ুর তেনকাশী জেলার সদর শহর হল তেনকাশী। চেন্নাই থেকে তেনকাশীর দূরত্ব রেলপথে ৬৭৬ কিলোমিটার। তেনকাশীর ভৌগোলিক কো-অরডিনেট ৮.৯ ডিগ্রী নর্থ, ৭৭.৩ ডিগ্রী ইস্ট। তামিলনাড়ু থেকে ট্রেনে কেরালা যাওয়ার অন্যতম প্রধান রুট হল তেনকাশী হয়ে। এর একদিকে সত্তুর শহর, অন্যদিকে পশ্চিমঘাট পর্বতের পূর্ব দিকের ঢাল। পশ্চিমঘাট পর্বতের একটি অংশের নাম ‘পদিগাই মালাই’ অর্থাৎ পদিগাই হিলস। এই পদিগাই পাহাড়ের অন্য নামগুলি হল ‘শিবজ্যোতিঃ হিলস’, ‘অগস্ত্য মুনি হিলস’ বা ‘দক্ষিণ কৈলাস’। বলা হয় যে ১৮৬৮ মিটার (৬১২৯ ফিট) উঁচু এই পর্বতে বসে অগস্ত্যমুনি প্রথম তামিল ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। পাহাড়ের মাথায় অগস্ত্যমুনির মূর্তি ও মন্দির আছে।
তেনকাশী ‘থিরিকুদা মালাই’ পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত। ‘থিরিকুদা মালাই’ পর্বতের দিক থেকে সব সময় একটা খুব সুন্দর বাতাস বয়, তার নাম ‘পদিগাই’। এই পদিগাই বাতাসের সঙ্গে তেনকাশীর কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের একটি সুন্দর (রহস্যময়?) সম্পর্ক আছে, সে সম্বন্ধে পরে বলছি।

তেনকাশী : লৌকিক কাহিনী
এখানে প্রচলিত একটি লৌকিক কাহিনী অনুসারে পাণ্ড্য রাজা পরাক্রম পাণ্ডিয়ান একবার ঠিক করেন যে কাশী থেকে একটি শিবলিঙ্গ নিয়ে এসে একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু একদিন রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন যে স্বয়ং শিব এসে তাঁকে বলছেন, “কাশী যাওয়ার দরকার নেই, পিঁপড়েরা তোমাকে পথ দেখাবে।” ঘুম ভেঙে উঠে রাজা দেখলেন সামনেই একসারি পিঁপড়ে চলেছে। রাজা স্বপ্নের কথা স্মরণ করে পিঁপড়ের সারি লক্ষ্য করতে করতে চলতে লাগলেন এবং একসময় পিঁপড়ের ঢিপির কাছে পৌঁছে দেখলেন যে সব পিঁপড়ে ঐ ঢিপিতে ঢুকে যাচ্ছে। রাজা তাঁর স্বপ্নের কথা স্মরণ করে ঐ ঢিপির উপরেই মন্দির বানিয়ে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে নাম দিলেন ‘কাশী বিশ্বনাথ’ মন্দির ও শিব, এবং জায়গাটির নাম দিলেন ‘তেন’ বা দক্ষিণ কাশী।

ইতিহাস
তেনকাশীর কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরটি পাণ্ড্য রাজা পরাক্রম পাণ্ডিয়ানের (১৪২৮ – ১৪৬০ খৃঃ) প্রতিষ্ঠিত ধরে নিলেও মন্দিরে খোদাই করা ১৩৮৪ খৃষ্টাব্দের একটি লিপিতে বীর পাণ্ড্যর নাম পাওয়া গেছে। হতে পারে যে রাজা পরাক্রম পাণ্ডিয়ান পুরোনো কোনও মন্দিরের উপর নতুন করে পাথরের মন্দিরটি তৈরী করিয়েছিলেন। দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য বড় মন্দিরের মত এই মন্দিরটিও বিভিন্ন রাজবংশের বিশেষ করে মাদুরাইয়ের নায়ক রাজাদের (খৃ্ষ্টীয় মধ্য-১৬শ শতক) আর্থিক সহায়তা-পুষ্ট।
মন্দির
দ্রাবিড় শৈলীর এই মন্দিরটির চারদিকে উঁচু গ্র্যানাইটের প্রাচীর। এর সাততলা ১৮০ ফিট উঁচু গোপুরমটি ভারতের ৮ম সর্বোচ্চ গোপুরম (কোথাও কোথাও এর উচ্চতা ১৯২ ফুট লেখা থাকলেও সেটা খুব সম্ভবতঃ ঠিক নয়)। এই গোপুরমটি ১৯৬৭ থেকে ১৯৯০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে নির্মিত। বলা হয় যে প্রাচীন গোপুরমটি বাজ পড়ে ভেঙে গিয়েছিল এবং তার জায়গায় এই গোপুরমটি নির্মাণ করা হয়েছে।
মন্দিরের গর্ভগৃহটি পূর্বমুখী। ভিতরে কাশী বিশ্বনাথ শিবলিঙ্গ অধিষ্ঠিত। এখানে পার্বতী ‘উলগাম্মান’ নামে পরিচিত। তাঁর মন্দির (সন্নিথি) কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরের পাশে এবং পূর্বমুখী। শিব-পার্বতী ছাড়াও গর্ভগৃহের দু’পাশে বিনায়ক (গণেশ) ও মুরুগান অর্থাৎ কার্তিকের মন্দির।
অন্যান্য দক্ষিণী মন্দিরের মত এই মন্দিরটিরও পাথরের ভাস্কর্যের কাজ খুবই সুন্দর। এই মন্দিরের দু’টি বিশেষত্ব হল মিউজিকাল পিলার এবং ‘বীরভদ্র স্তম্ভ’, যদিও তা ইউনিক নয়। দাক্ষিণাত্যের কিছু কিছু মন্দিরে মিউজিকাল পিলার এবং অনেক মন্দিরেই বীরভদ্র স্তম্ভ দেখা যায়। বীরভদ্র শিবের এক ভয়ংকর রূপ বা অবতার। বীরভদ্র রূপেই শিব দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করেন।

তেনকাশী : পদিগাই বাতাস
আগেই বলা হয়েছে তেনকাশীতে পাহাড়ের দিক থেকে সারাক্ষণ একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়। এই হাওয়াটিকে বলা হয় ‘পদিগাই বাতাস’ (Pothigai breeze)। তেনকাশীর কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরে ঢোকার আগে গোপুরমের খোলা দরজার সামনে দাঁড়ালে বুকে-মুখে একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগে (হাওয়ার গতিপথ মন্দির থেকে বাইরের দিকে)। গোপুরমের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই সেই হাওয়াটা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু গর্ভগৃহের দিকে কিছুটা এগোলেই হাওয়াটা আবার অনুভব করা যায়, কিন্তু এবার তার ডিরেকশন উলটো, অর্থাৎ বাইরের দিক থেকে ভিতরের দিকে। অর্থাৎ এবার হাওয়াটা পিঠে লাগবে এবং মনে হবে হাওয়াটা দর্শনার্থীকে গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
২১ আগস্ট ২০১৫ সালে তেনকাশী দর্শনের সময় আমি নিজেও এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছি।
পদিগাই বাতাসের এই দিক পরিবর্তনের ব্যাপারটির কথা গোপুরমের গেটের বাইরে একটি নোটিস বোর্ডে তামিল ও ইংরেজি ভাষায় লেখা আছে। সাধারণ ভক্তরা একে স্থান-মাহাত্ম্য বলে মনে করেন।

এই হাওয়ার দিক বদলের ব্যাপারটা আসলে কী?
আমার একজন বন্ধু (যিনি নিজে ফিজিক্সের টিচার) জানালেন যে এরকমটা হতেই পারে। যে হাওয়াটা পাহাড়ের দিক থেকে মন্দিরের চৌহদ্দির মধ্য দিয়ে বইছে, তার একটা অংশ গোপুরমের নীচের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে (যা ওখানে উপস্থিত সবার মুখে বুকে লাগছে), আর একটা অংশ উঁচু গোপুরম ও পাঁচিলে ধাক্কা খেয়ে রিফ্লেক্টেড হয়ে আবার পাহাড়ের দিকেই ফিরছে (যেটা ওখানে উপস্থিত সবার পিঠে লাগছে)।
এখন পদিগাই বাতাসের এই দিক পরিবর্তনের ব্যাপারটি আপনি কী ভাবে নেবেন, সেটা আপনার নিজের ব্যাপার।
উপসংহার
“দক্ষিণ কাশী”-র একটি হল তেনকাশী। শিবঠাকুরের খোঁজে একবার সেখানে যাওয়া যেতেই পারে। তেনকাশীর আর একটি বড় আকর্ষণ হল আট কিলোমিটার দূরের কোর্টালাম বা কুট্রালাম বলে একটি পাহাড়ি জায়গা, যা তার ওষধি-গুণ সম্পন্ন পাহাড়ি ঝর্ণা এবং কুট্রালানাথার শিবমন্দিরের জন্য বিখ্যাত। কুট্রালানাথার শিবমন্দিরের অংশ ‘চিথিরা সভাই’ (চিত্র সভা) হল শিবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত ‘পঞ্চসভাই স্থলঙ্গল’-য়ের পঞ্চম ‘সভাই’ (সভা)।
আরও পড়ুন- দক্ষিণ কাশী-অনাহত চক্রের পরম অধীশ্বর কাশী বিশ্বনাথ
শিবঠাকুরের খোঁজে আমাদের পঞ্চসভাই স্থলঙ্গলের পাঁচটি জায়গায় যেতেই হবে। পঞ্চসভাই স্থলম নিয়ে পরে পৃথক আলোচনা করা হবে।
চওঁ নমঃ শিবায়।

ঋণস্বীকার
উইকিপিডিয়া সহ বিভিন্ন ইন্টারনেট সাইট।
ফটো : লেখক
1 thought on “তেনকাশী – অনাহত চক্রের অধীশ্বর কাশী বিশ্বনাথের দক্ষিণকাশী ১ ”
প্রকাশা - দক্ষিণ কাশী দ্বিতীয় শিবঠাকুরের আপন দেশে
(21st December 2020 - 7:02 am)[…] […]
Comments are closed.