ভূতের পালকি ভূতের আলপনা বড়োই অদ্ভুত বাংলার লোকসংস্কৃতিতে।এই লোকাচার আলপনা শিল্পের মধ্যে আজও টিকে আছে হাওড়ার গ্রামেগঞ্জে ভূতচতুর্দশী উপলক্ষে।লিখছেন অরিন্দম সরকার।

আসছে ভূতের পালকি
তেপান্তরের হুদোসখানা মাঠ।কেউ কোত্থাও নেই।সাঁজ নামছে মাঠটি জুড়ে।শিয়ালদের হুক্কিহুয়া। ঝাঁকড়া গাছের মাথায় মাথায় জোস্তাপোঁকার ঝিকিমিকি। ঐ শোনা যায় কাহারদের ডাক–হুম হুনা রে হুম হুনা…। পালকি আসছে।ভাবছেন এবার নিশ্চয় রঘু ডাকাতের দল হা রে রে রে করে মাঠ ফাটিয়ে ডাক দেবে।হাতে তাদের জ্বলন্ত মশাল। আর তারপরই রুদ্ধশ্বাস ডাকাতি।কিন্তু সে গুড়ে বালি! পালকির দিকে একটিবার তাকান।আপনার রক্ত হিম হয়ে যাবে।
ভূতের পালকি আর ভূত দম্পতি
ভূত দম্প্তি। অমাবস্যার আঁধার মাখানো দেহ।চোখগুলো ভাঁটার মতো জ্বলন্ত।ভূত গৃহিনীর সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর।ভাবছেন গাঁজাখুড়ি গপ্পো।কিন্তু বিশ্বাস করুন এমন লোকবিশ্বাস জড়িয়ে আছে আমাদের বাংলার লোকসংস্কৃতিতে ভূতচতুর্শী উপলক্ষে হাওড়া জেলার গ্রামে গঞ্জে।বিশেষ করে ব্রাহ্মণ কায়স্থবাড়ির লোকাচারে। ভূতের পালকি করে যমালয় থেকে ভূতদম্পতির মর্ত্যে আগমন হয় বিশেষ করে সেই সেই বাড়িতে। আর সেটাই পালিত হয় এক বিচিত্র আলপনার মধ্য দিয়ে।
আলপনা
বাংলার মহিলাদের সৃষ্ট লোকজ চিত্রকলার দৃষ্টান্ত আলপনা।সাধারণত দেবমণ্ডপে উঠানে মাটির ঘরের দেওয়ালে চালগুড়ি বাটা দিয়ে আঁকা মাঙ্গল্য রেখাচিত্রকে আলপনা বলে। এটি একটি আচারমূলক শিল্প।গবেষকদের মতে আলপনার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন ও প্রতীকী চিত্র। যার উৎস নিহিত আছে স্মরণাতীত কালের আদিম গুহাচিত্রে।এই আদিম চিত্রকলা থেকে এসেছে একদিকে লিপি অন্যদিকে লোকজ আলপনা।সিন্ধুলিপি যার উল্লেখ্য দৃষ্টান্ত।আলপনায় যে ধরনের রৈখিক বিন্যাস দেখা যায় তার সঙ্গে নিবিড় মিল রয়েছে তাম্রাশ্মীয় সভ্যতার স্মারক নান কৌলাল পাত্রে অঙ্কিত মোটিফ ও জ্যামেতিক রেখাঙ্কনে।নানা ধরনের আলপনা দেখি।কিন্তু ভূতের আলপনা বিষয়টা সত্যি অভিনব।
ভূতচতুর্দশী ও ভূতের পালকি আল্পনায়
অতীতকে স্মরণ ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ভারতীয় তথা বাংলার সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে । মহালয়ের দিন খাদ্য ও জল নিবেদন করা হয় পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে এবং কালী পূজার আগের দিন অর্থাৎ ভূতচতুর্দশীর সন্ধ্যায় দীপ দেখানো হয় ।ভূত চতুর্দশীর বিশেষ আচার হলো,,,,দুপুরে চোদ্দশাক ভক্ষন,,সন্ধ্যায় চোদ্দপুরুষের উদ্দেশ্যে চোদ্দপ্রদীপ জ্বালানো ও ভূতের পালকি।
এই ভূতের পালকি আলপনা কোন কোন অঞ্চলে হয় ঠিক জানি না।হাওড়া জেলায় মূলত ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ সম্প্রদায়ের বাড়িতে ভূতচতুর্দশীর সন্ধ্যায় রান্নাঘর,,গোয়াল,,শোওয়ার ঘরের দরজার দুপাশে চালবাটা দিয়ে এই আলপনা দেয় বাড়ির গৃহিনী ।এই আলপনাতে একটি পালকি আঁকা হয় এর মধ্যে থাকেন ভূতদম্পতি ।স্ত্রী ভূতের কপালে সিঁদুর দেওয়া হয়।পালকি বহন করে চারটি ভূত।
আরও পড়ুন- গাড়সি ব্রত- প্রাগার্যসংস্কৃতির লোক ইতিহাসের অমূল্য উপাদানে সমৃদ্ধ
বিচিত্র লোকাচার
এই লোকাচারের সঠিক মিথটা সঠিক ভাবে কেও বলতে পারেন না। মনে হয় এই দিন ১৪পুরুষ তার বাড়ির ১৪ দীপ দেখে পালকি করে যমালয় থেকে নেমে আসেন তাঁদের বংশধর দের দেখতে ও তাদের আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট হয়ে আর্শিবাদ করেন। তাই এভাবে আলপনা এঁকে ও প্রদীপ জ্বেলে পূর্বপুরুষদের স্বাগতম জানানো হয় । পরের দিন সকালে ঐ আলপনা মুছে ফেলতে হয় গোবর জল দিয়ে। এভাবে আধুনিকতার যুগেও এই সব ছোট ছোট লোকাচারগুলো টিকিয়ে রাখার ক্ষুদ্র প্রয়াস এখনও গ্রামেগঞ্জে কিছু কিছু বাড়িতে বজায় রয়েছে।
2 thoughts on “ভূতের পালকি ভূতের আলপনা বড়োই অদ্ভুত বাংলার লোকসংস্কৃতিতে”
শ্রীপাট গোস্বামী মালিপাড়া -দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়েরে দেবতা
(3rd December 2020 - 7:49 am)[…] […]
ইতু ব্রত ও ইতু ব্রতকথা নারী ব্রতচর্যার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক
(16th December 2020 - 6:54 am)[…] […]
Comments are closed.